ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি জায়েজ | কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলমানদের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত একটি দিন। অনেকে এই দিনটিকে নবীর প্রতি ভালোবাসা ও আনন্দের দিন হিসেবে পালন করে থাকেন। অনেকেই আবার এটা বিদআত বলেও মনে করেন। মূলত এই দিনটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিনকে উদ্দেশ্য করে পালিত হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে এইভাবে আলাদা করে নবীজির জন্মদিন পালনের প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে মুসলিম শাসকদের উদ্যোগে ধীরে ধীরে এ দিনটিকে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করা শুরু হয়।

তবে এই বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে সরাসরি কোনো দিক নির্দেশনা নেই। এজন্য আলেম ওলামা বা সাধারণ মানুষের মধ্যে মতের ভিন্নতা দেখা যায়। কেউ মনে করেন এটি ভালোবাসা প্রকাশের একটি মাধ্যম, আবার কেউ বলেন এটি ইসলামি শরিয়তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, আসলেই মিলাদুন্নবী পালন করা কতটা সঠিক বা জায়েজ।

এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব, যাতে পাঠকরা সঠিক ধারণা লাভ করতে পারেন এবং নিজেদের আমল সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন।

ঈদে মিলাদুন্নবী কেন পালন করা হয়

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে স্মরণ করা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা। মুসলমানরা এ দিন যেভাবে পালন করেন-

  • নবী করিম (সা.) এর জন্মদিন স্মরণ করেন
  • তাঁর জীবন ও শিক্ষাকে প্রচার করেন
  • দোয়া, দরুদ ও কুরআন তেলাওয়াত করেন
  • মিলাদ মাহফিল ও ধর্মীয় আলোচনা করেন
  • মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেন

অর্থাৎ, মিলাদুন্নবী পালনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নবীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাঁর শিক্ষা থেকে প্রেরণা নেওয়া।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি জায়েজ?

মুসলিম সমাজের মধ্যে মিলাদুন্নবী পালন বৈধ নাকি অবৈধ এটা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। কেউ এটিকে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ মনে করেন, আবার কেউ বিদআত বলে মন্তব্য করেন। এজন্যই বিষয়টি কুরআন ও হাদিসের আলোকে দেখা জরুরি।

কুরআনের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী

কুরআনে সরাসরি ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিক নির্দেশনা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা নবীজির আগমনকে মানবজাতির জন্য অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন—

“আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ) সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (আল-আম্বিয়া ২১:১০৭)।

এই নির্দেশনা থেকে অনেক আলেমগনের মতে নবীর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁর জীবন ও শিক্ষার আলোচনা করা জায়েজ আছে। যদি সেটি নতুন কোনো ইবাদত বা বাধ্যতামূলক উৎসবের মতো না হয়।

হাদিসের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী

সহিহ হাদিসে নির্দিষ্টভাবে “মিলাদ অনুষ্ঠান” করার নির্দেশ নেই। তবে ইঙ্গিত মেলে যে নবীর জন্মদিন স্মরণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন এবং বলতেন:

“এটি সেই দিন, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে।”(সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৬২)।

অতএব, জন্মদিন উপলক্ষে নফল ইবাদত করা বা খুশি প্রকাশ করা জায়েজ হতে পারে। তবে এটিকে শরিয়ত ভিত্তিক উৎসব বা নতুন ইবাদত হিসেবে স্থায়ী করা ঠিক হবেনা।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি বিদআত?

বিদআত বলতে ইসলাম ধর্মে নতুন করে কোনো ইবাদত যোগ করাকে বোঝায়। যেহেতু রাসুল (সা.) নিজে বা সাহাবীগণ এ ধরনের কোন অনুষ্ঠান পালন করেননি, তাই অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ বা আলেমের মত অনুযায়ী একে বিদআত বলা হয়ে থাকে। তবে কিছু আলেম মনে করেন, যদি নবীর স্মরণ ও শিক্ষা প্রচারই মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা নিন্দনীয় কোন কাজ নয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী বিদআত কেন বলা হয়

কুরআন ও সহিহ হাদিসে নির্দিষ্টভাবে “মিলাদ অনুষ্ঠান” করার সুস্পষ্ট দলিল নেই, আর সাহাবা-তাবেঈনদের যুগেও এ রকম আয়োজন করার কোন প্রমাণ নেই। তাই অনেক আলেম মনে করেন এটিকে নির্ধারিত উৎসবের মতো বানানো হয়েছে এবং নতুন ইবাদতের নিয়ম চালু করে বধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে শুধু নফল নামাজ, দোয়া-দরুদ, সীরাত আলোচনা ও শিক্ষা নেওয়া যদি নতুন ইবাদতের মতো নির্ধারণ করা না হয়ে থাকে তাহলে সে অংশকে অনেকেই বিদআত বলেন না।

মিলাদ ও বিদআতের পার্থক্য

মিলাদ বলতে সাধারণত নবীজি (সা.) এর স্মরণে, নাত/কবিতা পাঠ, ও সীরাত আলোচনা বোঝায়। আর বিদআত হলো শরিয়তে নতুন কোন ইবাদত যোগ করা অথবা কোনো আমলকে নির্দিষ্ট সময় বা পদ্ধতিতে বাধ্যতামূলক করা। অর্থাৎ উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ঠিক থাকলে তা স্মরণ ও দাওয়াহ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু নতুন ধর্মীয় বিধান তৈরির রূপ নিলে তবে সেটাই বিদআত বলে গন্য হয়।

বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী কিভাবে পালিত হয়

বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এদিন বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা এবং ইসলামি প্রতিষ্ঠানে মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সরকারি পর্যায়েও নানা ধরনের কর্মসূচি থাকে। সাধারণ মানুষও এ দিনে নফল নামাজ আদায়, দরুদ পাঠ এবং দোয়ার মাধ্যমে নবীজির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকেন।

সুন্নিরা কি ঈদে মিলাদ পালন করে?

বিশ্বের অনেক সুন্নি মুসলিম ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী অনেক জনপ্রিয়। তবে সালাফি বা ওহাবি মতাদর্শীরা এ আয়োজনকে বিদআত বলে মনে করেন। অর্থাৎ, এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও অনেক মুসলিম দেশ এখনো এটিকে ভালোবাসেন ও শ্রদ্ধার প্রকাশ হিসেবে দেখে থাকেন।

পরিশেষে

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনে ইসলামি দৃষ্টিকোন থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকাটা স্বাভাবিক। কেউ একে আনন্দ ও ভালোবাসার দিন হিসেবে দেখেন, কেউ আবার এটাকে বিদআত বলেও সমালোচনা করে। কিন্তু মূল কথা হলো নবীজির শিক্ষা ও আদর্শকে আমাদের জীবনে ধারণ করা। কারণ, শুধু পালন নয়, তাঁর দেখানো পথে চলাই আমাদের জন্য সঠিক পথ এবং সবচেয়ে বড় ইবাদত।

 

আরও দেখুন:

ঈদে মিলাদুন্নবী কবে | ঈদে মিলাদুন্নবী কত তারিখ ২০২৫

Leave a Comment